পশ্চিমবঙ্গের একটি কৃষিপ্রধান রাজ্য হিসেবে কৃষকদের কল্যাণে বহু সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি উদ্যোগ হলো Bangla Shasya Bima প্রকল্প। এটি মূলত একটি সরকার-পৃষ্ঠপোষিত ফসল বিমা প্রকল্প যা প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত কারণে ফসলের ক্ষতির ক্ষেত্রে কৃষকদের আর্থিক সুরক্ষা দেয়। আজকের দিনে কৃষকরা যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন — খরা, অতিবৃষ্টি, ঝড়-জলছবি কিংবা শস্যের মূল্যহ্রাস — তার মোকাবিলায় Bangla Shasya Bima প্রকল্প একটি শক্তিশালী অস্ত্র।
Bangla Shasya Bima প্রকল্পের সূচনা ও সরকারের উদ্দেশ্য
Bangla Shasya Bima প্রকল্পের সূচনা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কৃষি দপ্তরের অধীনে, কৃষকদের আয় সুরক্ষিত রাখার জন্য। এটি মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের “প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা” (PMFBY)-র সাথে সামঞ্জস্য রেখে চালু করা হয়েছে, তবে এই প্রকল্পে পশ্চিমবঙ্গ সরকারই পুরো প্রিমিয়ামের দায়িত্ব নেয়।
এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো:
- প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ক্ষতির আর্থিক ভার লাঘব করা
- কৃষকদের চাষাবাদে উৎসাহ দেওয়া
- কৃষি আয় স্থিতিশীল রাখা
- ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের বাঁচিয়ে রাখা
- কৃষি উৎপাদনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা
Bangla Shasya Bima প্রকল্পের আওতায় কোন কোন ফসল অন্তর্ভুক্ত থাকে
এই প্রকল্পের আওতায় রাজ্যে চাষযোগ্য প্রায় সব মৌসুমি প্রধান ফসলের বিমা প্রদান করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে:
- আমন ধান
- বোরো ধান
- আউশ ধান
- পাট
- ভুট্টা
- আলু
- সরষে
- গম
প্রতি মৌসুম অনুযায়ী জেলাভিত্তিক ফসল নির্ধারণ করা হয় এবং সেই অনুযায়ী Bangla Shasya Bima প্রকল্প চালু থাকে।
Bangla Shasya Bima প্রকল্পে কারা নাম নথিভুক্ত করতে পারেন
Bangla Shasya Bima প্রকল্পের সবচেয়ে বড় দিক হলো এটি একেবারেই বিনামূল্যে। কৃষকদের কোনও প্রিমিয়াম দিতে হয় না। এই প্রকল্পে নথিভুক্ত হওয়ার জন্য কৃষককে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হতে হবে এবং বৈধ জমির মালিক বা চাষি হতে হবে। প্রকল্পের উপযুক্ত অংশগ্রহণকারীরা হলেন:
- ক্ষুদ্র চাষি (যাদের জমির পরিমাণ ১ হেক্টরের কম)
- প্রান্তিক চাষি (যাদের জমির পরিমাণ ১–২ হেক্টর)
- ব্যাংক ঋণপ্রাপ্ত চাষিরা
- স্বনির্ভর বা ঋণবিহীন চাষিরাও
Bangla Shasya Bima প্রকল্পে নাম নথিভুক্তির পদ্ধতি ও প্রয়োজনীয় নথিপত্র
এই প্রকল্পে নাম নথিভুক্ত করতে চাইলে একজন কৃষককে সংশ্লিষ্ট ব্লক কৃষি দপ্তর বা জেলা কৃষি আধিকারিকের অফিসে আবেদন করতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নাম নথিভুক্তির জন্য ক্যাম্প বা অনলাইন ফর্ম পূরণের ব্যবস্থাও করা হয়।
প্রয়োজনীয় নথিপত্র:
- আধার কার্ড (ভোটার কার্ড বিকল্প হিসেবে চলতে পারে)
- জমির রেকর্ড (ROR বা খতিয়ান)
- ব্যাংক পাসবুকের কপি
- মোবাইল নম্বর
- পাসপোর্ট সাইজ ছবি
Bangla Shasya Bima প্রকল্পে কীভাবে ক্ষতিপূরণ নির্ধারিত হয় এবং কীভাবে প্রদান করা হয়
ফসল চাষ চলাকালীন সময়ে বা ফসল তোলার আগে যদি কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে এবং শস্যের ক্ষতি হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্লকের কৃষি আধিকারিকের কাছে বিষয়টি রিপোর্ট করতে হয়। এরপর নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে “ক্রপ কাটিং এক্সপেরিমেন্ট” (CCE) করা হয়, যার মাধ্যমে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারিত হয়।
CCE-র ভিত্তিতে বিমা কোম্পানি ক্ষতিপূরণ অনুমোদন করে এবং সেই ক্ষতিপূরণ কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে DBT (Direct Benefit Transfer)-এর মাধ্যমে সরাসরি জমা পড়ে।
Bangla Shasya Bima প্রকল্পের সাফল্যের কিছু বাস্তব উদাহরণ
২০২৩ সালে বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ায় খরার কারণে বহু কৃষকের ধান চাষ ব্যাহত হয়েছিল। সেই সময় Bangla Shasya Bima প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৭০ হাজারের বেশি কৃষক ক্ষতিপূরণ পান। অনেকে ১০,০০০ টাকা থেকে শুরু করে ২৫,০০০ টাকা পর্যন্ত বিমার টাকা পান, যা তাঁদের পরিবারকে আর্থিকভাবে রক্ষা করতে সহায়ক হয়েছিল।
অন্যদিকে উত্তর ২৪ পরগনায় অতিবৃষ্টির ফলে আলু চাষে ক্ষতি হয়েছিল, সেখানে প্রায় ২০,০০০ কৃষক সরাসরি ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন এই প্রকল্পের মাধ্যমে।
Bangla Shasya Bima প্রকল্পের সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ
প্রধান সুবিধাসমূহ:
- সম্পূর্ণ বিনামূল্যে
- প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা
- ক্ষতিপূরণ সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে
- কৃষি ঋণ পরিশোধে সহায়ক
- কৃষকের আয় নিশ্চিত হয়
চ্যালেঞ্জসমূহ:
- অনেক কৃষক এখনো প্রকল্প সম্পর্কে অবগত নন
- কিছু অঞ্চলে বিলম্বে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়
- ডিজিটাল লিটারেসি না থাকায় অনলাইন আবেদন কঠিন হয়
Bangla Shasya Bima প্রকল্পের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের দিক
পশ্চিমবঙ্গ সরকার চাইছে এই প্রকল্পকে আরও শক্তিশালী করতে। আগামীতে নিচের বিষয়গুলোতে জোর দেওয়া হচ্ছে:
- ডিজিটাল আবেদন ব্যবস্থা আরও সহজ করা
- SMS বা মোবাইল অ্যাপ-এর মাধ্যমে ক্ষতিপূরণের অগ্রগতি জানা
- গ্রাম পর্যায়ে সচেতনতা শিবির বাড়ানো
- বিমা সংস্থার সাথে সরাসরি কৃষকের যোগাযোগের ব্যবস্থাপনা
উপসংহার: Bangla Shasya Bima প্রকল্প কৃষকের আত্মবিশ্বাস ও স্বনির্ভরতার প্রতীক
Bangla Shasya Bima প্রকল্প শুধুই একটি বিমা প্রকল্প নয়, বরং এটি কৃষকদের আত্মবিশ্বাস জোগায় এবং তাঁদের কঠোর পরিশ্রমের প্রতিদান সুনিশ্চিত করে। এই প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন ও সময়মতো ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা গেলে, পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য এটি একটি শক্তিশালী নিরাপত্তা বলয় হিসেবে কাজ করবে।
রাজ্যের প্রতিটি কৃষকের উচিত এই প্রকল্পের সুবিধা গ্রহণ করা এবং তাঁদের ফসল ও ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত রাখা।
Read More: খাদ্য সাথী প্রকল্পের অধীনে রেশন কার্ডে ঠিকানা পরিবর্তন করুন
